সুস্থ থাকতে কিছু সময় প্রকৃতির মাঝে কাটাতে ভুলবেন না যেন!


সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্র অনুসারে দিনের কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে কাটালে ব্রেন পাওয়ার মারাত্মক বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে মেলে অনেক শারীরিক উপকারিতাও। লন্ডনের কিং কলেজের গবেষকদের করা এই গবেষণা অনুসারে গাছ-গাছালির মধ্যে, পাখিদের কলতান শুনতে শুনতে কিছু সময় ব্যয় করলে স্ট্রেস লেভেল কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের অন্দরে এমন কিছু হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায় যে তার প্রভাবে ব্রেন পাওয়ারও বৃদ্ধি পায়। ফলে কমে নানাবিধ ব্রেন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু প্রশ্ন হল প্রকৃতির মাঝে কতটা সময় কাটালে উপকার মিলতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গবেষকরা একটি মোবাইল অ্যাপ আবিষ্কার করেছেন, যাকে কাজে লাগিয়ে সহজেই জেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে আপনি যতটুকু সময় পরিবেশের মাঝে কাটিয়েছেন, তার প্রভাবে আপনার শরীরের কতটা উপকার হয়েছে, সে সম্পর্কে। সেই অ্যাপটিকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ১০৮ জনের উপর এই পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল। তারপর সব ডেটা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে মেন্টাল হেলথের সঙ্গে প্রকৃতির একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা কোনও ভাবেই অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়। আজকের এই প্রতিযোগীতাপূর্ণ পরিবেশে যে হারে সবার স্ট্রেস লেভেল বাড়ছে, তাতে প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করার প্রয়োজন যে বেড়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। প্রসঙ্গত, নানাবিধ সমীক্ষা রিপোর্টের দিকে নজর ফেরালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আজকের প্রজন্ম সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে রয়েছে। এই না একটা রোগের বোমা এসে পরে, আর আমনি জীবনটা শেষ হয়ে যায়। আর এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় একেবারেই! গাজা স্ট্রিপে বেঁচে থাকা মুষ্টিমেয় প্যালেস্থানীয়দের জীবনের নিশ্চয়তা যেমন কেরে নিয়েছে ইজরায়েলি ক্ষেপনাস্ত্র, তেমনি স্ট্রেস আমাদের আয়ুর পরিধি কমিয়েছে চোখে পরার মতো। এমন অবস্থায় মৃত্যুমুখ থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে পারে একমাত্র গ্রিন থেরাপি, অর্থাৎ প্রকৃতি। কী এই গ্রিন থেরাপি? জীববিজ্ঞানীদের মতে প্রকৃতির অল্প ছোঁয়াতে যে কেবল মস্তষ্কের ক্ষমতা বাড়ে, এমন নয়, সেঙ্গে একাধিক জোটিল রোগের উপশমও ঘটে। কারণ প্রকৃতির শরীরে এতটাই শক্তি লুকিয়ে রয়েছে যে, যে কানও রোগকে সমূলে সারিয়ে তুলতে সময়েই লাগে না। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে চিকিৎসা করা হয়, তাকেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় গ্রিন থেরাপি বলা হয়ে থাকে। আর সব থেকে মজার বিষয় হল গ্রিন থেরাপির সুফল পেতে কোনও ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার প্রয়োজন পরে না। শুধু কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে কাটালেই উপকার মিলতে শুরু করে। প্রকৃতির সঙ্গে থাকাকালীন আমাদের মস্তিষ্ক এবং শরীরে একাধিক পরিবর্তন হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বিশেষ কিছু হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্রেন এবং শরীরের কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ফলে ধীরে ধীরে স্ট্রেস এবং অন্যান্য একাধিক রোগ কমতে শুরু করে। প্রসঙ্গত, নিজের উপর নানাভাবে গ্রিন থেরাপি করতে পারেন। যেমন ধরুন...

১. শরীরিক সচলতা বাড়ায়: অফিসের পর পার্কে কিছুটা সময় কাটাতে শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই এক জায়গায় না বসে একটু হাঁটাহাঁটি হয়েই যায়। এমনটা হওয়ার কারণে সারা শরীরে রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায়। ফলে দেহের প্রতিটা অঙ্গে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই শরীরের কর্মক্ষমতা এবং সচলতা বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গত, একাধিক গবেষণায় একথা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে প্রতিদিন প্রকৃতির মাঝে কিচুটা সময় হাঁটলে হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে ওজন কমে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায় এবং ডিপ্রেশনের মতো রোগ দূরে থাকে।

২.সমাজিকতার সুযোগ মেলে: নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জুগে লোকজন যেন চেনা মানুষের বাইরে কারও সঙ্গেই মিশতে পারে না। ফলে সামান্য কিছুতেই একাকিত্ব এমনভাবে ঘিরে ধরে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সরাসরি না হলেও প্রকৃতি কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে পারে। কীভাবে? রোজ সকাল-বিকাল পার্কে হাঁটতে গেলে মুখ চেনা মানুষদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর ধীরে ধীরে এই মানুষগুলির সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা কখন যে আকাশ ছোঁয়, তা আমরা অনেকই বুঝে উঠতে পারি না। ফলে চেনা মানুষের পরিধিটা বাড়তে থাকে। ফলে কমতে থাকে একাকিত্ব এবং বিষন্নতা।

৩. ক্লান্তি দূর হয়: আগেকার দিনে অসুস্থ হলেই চিকিৎসকেরা জল হওয়া বদলানোর পরামর্শ দিতেন। কেন জানেন? কারণ প্রকৃতির কোলে সময় কাটালে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটতে থাকে। ফলে রোগ-ভোগের আশঙ্কা হ্রাস পায়। সেই সঙ্গে শরীরও চনমনে হয়ে ওঠে। ফলে ক্লান্তি দূর হয়। তাই তো প্রতি মাসে যদি বেরাতে যাওয়ার সুযোগ না পান, ক্ষতি নেই! প্রতিদিন কম করে ৩০ মিনিট প্রকৃতির মাঝে কাটানোর চেষ্টা করুন, তাহলেই দেখবেন উপকার মিলতে শুরু করেছে।

৪. আউট ডোর অ্যাকটিভিটি: নানা ধরনের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে অংশ নেওয়াও এক ধরনের গ্রিন থেরাপি। কারণ যখনই আপনি বাড়ির বাইরে, পরিবেশের কাছাকাছি গিয়ে কোনও কাজ করছেন, তখন পরিবেশের ভাল প্রভাব আপনার মন, শরীর এবং মস্তিষ্কের উপর পরতে থাকে। ফলে নানাভাবে উপকার মেলে। রক ক্লাইম্বিং, রাফটিং অথবা বন্ধুরা মিলে সবুজ ঘেরা পার্কে কয়েক চক্কর হাঁটা মারলেও দারুন উপকার পাওয়া যায়।

৫.মানসিক অবসাদ কমায়: জীবনযুদ্ধ প্রতিদিন এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে যে মানসিক চাপ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর যার প্রভাব সরাসরি পরছে পরিবারের বাকি সদস্যদের উপর। ফলে ভাঙছে সম্পর্ক। বাড়ছে একাকিত্ব। এমন পরিস্থিতিতে প্রকৃতিই কিন্তু আপনার একমাত্র বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। কারণ যেমনটা আগেও আলোচনা করা হয়েছে, প্রকৃতি হল সেই ওষুধ যা নিমেষে মানসিক অবসাদ কমায়। ফলে কাঁটার মুকুট পরেও হাসির সন্ধান পেতে কষ্ট হয় না।

৬. মনকে নিমেষে ভাল করে দেয়: মানসিক চাপের কারণে মন যখন বিধ্বস্ত, তখন কিছুটা সময় খারাপ ভাবনার থেকে ছুটি নিয়ে পার্কে গিয়ে বসে থাকতে ক্ষতি কী! দেখবেন নিমেষে মন ভাল হয়ে যাবে। আসলে প্রকৃতির অন্দরে এমন কিছু ক্ষমতা থাকে যা মানসিক ক্ষতকে চোখের পলকে ভরিয়ে তোলে। ফলে মন একেবারে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তাছাড়া সবুজের কাছাকাছি এলে আমাদের মস্তিষ্কে বিশেষ কিছু হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই হরমোনগুলিও স্ট্রেস কমাতে বিশেষ ভূমিকা নেয়।

৭.সম্পর্ক যেন সকল গণ্ডি পেরোয়: আচ্ছা মানব জীবনে কি শুধু মানুষের সঙ্গেই সম্পর্ক হয়? ভাল করে ভেবে দেখুন, এমনটা কিন্তু হয় না। এই সেদিন যেমন অফিস আসার পথে রাস্তার একটা কুকুরের সঙ্গে বেজায় বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এখন ওকে দেখলেই বিস্কুট খাওয়াই। আর লেজ নারাতে নারাতে ব্যাটা আমার পিছু নেয়। এই ভাবে গ্রিন থেরাপির দৌলতে প্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকা বাকি প্রাণীদের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক তৈরি হতে শুরু করে। আর এমন সম্পর্ক যে শরীর এবং মনের জন্য় বেশ উপকারি, তা বিজ্ঞান ইতিমধ্যেই প্রমাণ করে ছেড়েছে।

৮.গ্রিন থেরাপির আরও বেশ কিছু প্রয়োজনীয়তা: সময় বদলাচ্ছে। সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে মানসিকতাও। এখন প্রতিযোগিতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মনকে চাঙ্গা রাখতে কিছু সময়ের জন্য হলেও ব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রিন থেরাপির আর কোনও বিকল্প আছে বলে তো মনে হয় না। বেশি কিছু করতে হবে না। প্রতিদিন সকালে আধ ঘন্টা খালি পায়ে ঘাসের উপরে হাঁটুন। তাহলেই এত উপকার পাবেন যে আর অন্য কোনও ধরনের শারীরচর্চা করার প্রয়োজনই পরবে না।

Random Post